একভরি সোনার দাম সত্তর হাজার টাকা

লোহা রাস্তাঘাটে পড়ে পাওয়া যায়। সোনার জন্য সংসারে অশান্তি হয়, ছিনতাই-রাহাজানি হয়, দেশের রিজার্ভের পরিমানও সোনা দিয়ে মাপা হয়। আর লোহা? ছোটবেলা চুম্বকের টুকরা একটা সাদা কাগজের উপর রেখে পিচঢালা রাস্তায় গিয়ে নুড়ি পাথরের ওপর ঘুরাতাম; তাতে ছোট্ট ছোট্ট লোহার কণা কাগজের অপর প্রান্তে উঠে আসত; আমরা মজা পেতাম। লোহার প্রাপ্যতা বা মূল্য হলো এই।
এখন ধরুন, পৃথিবীতে লোহার চরম আকাল দেখা দিল; লোহা দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেল। অন্যদিকে, স্বর্ণের খনি উঠলো
এখানে-ওখানে। ফলাফল কী হবে? স্বর্ণের দাম আর লোহার দাম স্থান বদল করবে না? করবে, অতি অবশ্যই করবে।
না, শুধু দাম বদল করবে না। লোহার দাম হবে হীরার চেয়ে বেশি। কারণ, এটা অতি প্রয়োজনীয়, অতি উপকারী বস্তু, সোনার মতো  দর্শনদারী কেবল নয় এটা।
সোনা আর লোহা থেকে অন্যদিকে যাই। আমার আপন আত্মীয়( সমন্ধটি বলতে চাইছি না সঙ্গত কারণে)-এর যখন দুটি/তিনটি সন্তান, তখন সবাই বলাবলি করেছে, “অতবড় তাল্লুত কেডা খাইবো! সুনা-রুপা দিয়া মুড়ায়া দিলেও ত শ্যাষ অইতো না। পুলাপান না হইলে কেমনেতে!” ফলশ্রুতিতে তাদের নয়টি সন্তান। নয় সন্তান বড় হয়েছে। এখন সন্তানে সন্তানে সম্পদ নিয়ে বচসা; এর এটা পছন্দ না, ওর ঐটা পছন্দ না। এ চায় ঐটা, ও চায় এটা। এসবের জন্য মানুষের আদরে আদরে বেড়ে ওঠারা এখন বিরক্তির কারণ। এখন এদেরকে ছাঁই দিয়ে মুড়াতেও কেউ আসবে না।
আবারও অন্যদিকে যাই। পেশা সূত্রে আমার পরিচয় হয়েছিল ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসকারী এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর সাথে। কথায় কথায় তিনি বললেন,”আমাকে একবার একজন ফিনিসীয় লোক জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের দেশে কি ঘাস আছে? আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, তোমার মাথায় এমন উদ্ভট প্রশ্ন আসলো কেন? সে বলল, তোমাদের অতটুকু দেশে এত মানুষ! সবাই দাঁড়ালে তো খালি জায়গা থাকার কথা না।”
বস্তুত, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলো আমাদের এই বাংলাদেশ। একটা স্ট্যান্ডার্ড দেশের আয়তন ও জনসংখ্যার অনুপাত বিচার করলে এদেশের জনসংখ্যা হওয়া উচিত সর্বোচ্চ দুই কোটি। এখন এখানে আছে কমপক্ষে বাইশ কোটি (মিরপুর মাথায় রেখেই বলছি)। দুই কোটির স্থানে যখন বাইশ কোটি হয়ে যায়, তখন পরিস্থিতি ঠিক আমার সেই আত্মীয়ের পরিবারের মতোই হয়।
আবার অন্য প্রসঙ্গে যাই। পেশা সূত্রেই আমার পরিচয় হয়েছে এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত  স্কটিশ নাগরিকের সাথে। এক সন্ধ্যায় তিনি বলেছিলেন, এদেশে অনেক সমস্যা, তারপরেও তিনি এখানে ব্যবসা করতে এসেছেন, ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ এখানে প্রচুর মানুষ আর মানুষ মানেই ক্রেতা।
বাঙালির অতি আধিক্যের ফলে এখানে মৌলিক চাহিদাগুলো অপ্রতুল। ন্যূনতম মানবিক মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত হবার সাথে সাথে এরা বাস্তবতা জ্ঞানহীন, বিদ্যাচর্চাহীন, কূপমণ্ডূক। সম্পদের আকালে ন্যূনতম মানবিক মৌলিকা চাহিদার যোগানহীন এইসব বাঙালি তাই বিভিন্ন প্রপান্ডার শিকার। বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায়ী এদের নিয়ে খেলা করে। এরা তা জানে না। এদেরকে যে যেভাবে পারে, মগজ ধোলাই দেয়; মগজ ধোলাই দিয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়, এদের দিয়ে ব্যবসা করে, নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে।
বাঙালি নিজের শিকড় জানে না; নিজের কৃষ্টি জানে না, সংস্কৃতি জানে না। নিজে বঞ্চিত থাকে বলে এরা আশেপাশের অন্যকেও বঞ্চিত করতে চায়। প্রচন্ড পরশ্রীকাতরতা এদেরকে সর্বক্ষণ গ্রাস করে রাখে। নিজের উন্নয়নের চেয়ে এরা অপরের ধ্বংস দেখতে বেশি আনন্দ পায়। কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রা করলে এদের গাত্রদাহ শুরু হয়, কেউ টিপ পরলে এদের ধর্ম চলে যায়, কেউ সংস্কৃতি চর্চা করলে তাকে আক্রমণ করতে আসে, ফেসবুকে গিয়ে জাহান্নামি বলে ভুল বানানে বিচারের রায় শুনিয়ে দেয়….
বলে শেষ করা যাবে না। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, প্রতিক্রিয়াশীল এই জনগোষ্ঠীকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, এত যে লাফান, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, প্রতিবেশীর জন্য উপকারে আসে- এমন কী করেছেন। জীবন  তো কাটাচ্ছেন পরের জিনিসেই, তো আপনার এত বাড়-বাড়ন্তি কেন!
বাঙালির আধিক্য হ্রাস পেয়ে যতদিন না একটা স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে আসবে, ততদিন এইসব প্রোপান্ডার শিকার মানুষ-আবর্জনাও থাকবে এবং জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাহীন থেকে থেকে ধরণীকে বিষাক্ত করতে থাকবে।
কূপমণ্ডূক বাঙালি হ্রাস পাক, এই ধরণী ভালো থাক।