রাক্ষস নদীর পাড়

“নদীই সব দিছে, আবার নদীই কাইড়া নিছে।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলা কথাটির বক্তার দিকে আমি তাকালাম। লালচে ভাবের চুল মাথায়, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে, জিন্স আর পোলো শার্ট পরা। জিন্সটা ময়লাটে, বোধহয় মাস খানেক ধরে টানা পরছে। পোলো শার্টটা প্রস্থে কালো আর বেগুনি রঙের স্ট্রাইপড, কালো বলে অতটা ময়লা বোঝা যায় না, তবে জীর্ণতা তাতে ঢাকা পড়েনি। মানুষটির দিকে আমি দরদ মাখা চোখে তাকালাম। ঘুরতে এসে নদীর পাড়ে যে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আমি চা পান করতে করতে নদী দেখছি, সে টং দোকানের দোকানদারকেই লোকটি কথাগুলো বলছিল। লোকটিকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় অজস্র ভাবনা খেলে গেল। আহা, এমন একটা মানুষ নদীতে সব হারিয়েছে! নদীই নাকি সব দিয়েছিল, সেই নদীই আবার সব কেড়ে নিয়েছে! হায়রে নদীর পাড়ের মানুষের জীবন! হায়রে নিয়তি! হায়রে মানুষের অসহায়ত্ব!
লোকটাকে দেখে খুব একটা শিক্ষিত বলে মনে হয়না, হয়ত বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছে, এরপর হয়ত কাজে নেমে গেছে। নদীর পাড়ের মানুষগুলোর জীবন তো এমনই হয়! সামান্য হিসাব কিতাব শিখে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ে….! না জানি কত কি ছিল, না জানি কত কি হারিয়েছে!
“অহন কি করবেন? বসের লগে কতা হইছে?” দোকানী জিজ্ঞেস করলো। আমি চা খাওয়ার ভান করে নদীভাঙা মানুষটার কথা শুনছি।
“যা হইবার তাই হইবো। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে হইবো। আবার সব ঠিক হইয়া যাবে। কয়দিন আর আটকায়া রাখবো!”
আমি চমকিত হলাম লোকটির আশাবাদী মনস্তত্ত্বের পরিচয় পেয়ে। দ্যাটস দ্য স্পিরিট! যুগে যুগে এইসব মানুষই মানব জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, কোন বাধা তাদের রুখতে পারেনি। মানুষের আজ যা উন্নতি, তা শুধু এধরণের আশাবাদী মানুষের জন্যই হয়েছে। সালাম, ভাই, তোমাকে অন্তর থেকে সালাম!
“হ, ভাই, কয়ডা দিন দৈইযযো দরেন। এই গরম ভাব বেশি দিন থাকবোনা। আমিওতো কম দেকলাম না!” দোকানী যেন সান্ত্বনা দিল লোকটিকে। আমার তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে সে কোত্থেকে এসেছে, কি ছিল তার, কি হারিয়ে গেলো, এখন সে কি করবে…. ভাবতে ভাবতে মনটা আরো খারাপ হলো।
“থাক, যাই। কাম ধান্ধা বাইর করতে হইবো। “
“আইচ্ছা বাই, আল্লাহ ভরসা। দুইদিন পরেওই সব ঠিক হইয়া যাইবো। টেনশনের কিছু নাই।”
লোকটি হাঁটা দিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে এলো আমার। চায়ের কাপ দিতে দিতে দোকানীকে বললাম, “নদী যে কত মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে! আহা, এমন একটা মানুষ সব হারালো! কি একটা অবস্থা! না জানি কত কি হারিয়েছে সে!”
“নদীর উপ্রে বড় বড় বালু মহাল, ইট মহাল আছিলো তার, গুদাম আছিলো। ক্ষমতা দিয়া চেরেস্টা করছে রাখার, পারে নাই।”
“আহারে! কি কান্ড!”
“মবিল কুট আইছিল, বিয়াইডাব্লুর, বড় বড় গাড়ি দিয়া সব ভাইঙা দিয়া গেছে।