সৃজনশীলশিক্ষা – নামকরণের স্বার্থকতা

কয়েক বছর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় “যেমন খুশি তেমন সাজো” খেলা চলেছে। শিক্ষা নীতি প্রণয়নকারী জ্ঞানীগুণীজনেরা বাইরের দেশে যা দেখেছেন, যা তাদের কাছে অভিনব ও চমকপ্রদ বলে মনে হয়েছে, তা-ই এখানে এনে প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। খুব সম্ভবত তাঁরা বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হচ্ছে মহোত্তম বিষয়, এর কোন উপযোগিতা থাকতে নেই। সে থেকেই হয়তো একটা সেই লেভেলের গিনিপিগ গিনিপিগ খেলা হয়ে গেছে এদেশে। শিক্ষাদানের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় দেখেছি সৃজনশীল আর কমুনিকেটিভ পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্দান্ত সব  ফসল। এসব ফসল যখন বড় হয়ে হাল ধরতে আসবে, তখন যে কী হাল হবে ভাবতে ভাবতে মাঝেমাঝে কৌতুক বোধ করি।
সৃজনশীল এবং কমুনিকেটিভ পদ্ধতির শিক্ষা নিয়ে আগেও লিখেছিলাম, আজকেও লিখছি। আজ লিখছি সৃজনশীল ভূগোল ও নামকরণ নিয়ে।
ভূগোল বিদ্যার শিক্ষক জনাব জামান শিপলু শ্রেণিকক্ষে পড়াতে পড়াতে জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো, কোন্ অঞ্চলে শীত বেশি পড়ে?” উম্মুক্ত প্রশ্ন, যেকেউ উত্তর দিতে পারবে। ক্লাশের মেধাবী শিক্ষার্থী আসাদ উত্তর দিল, “স্যার, তুন্দ্রা অঞ্চলে।”
-আচ্ছা। তুন্দ্রা অঞ্চলে যে শীত বেশি- এটা কী করে জানতে পারি?
এই সম্পূরক প্রশ্নে আসাদ চুপ মেরে গেল। কারণ সে বুঝতে পারলো এটা সৃজনশীল প্রশ্ন এবং এর উত্তরও সৃজনশীল হতে হবে। ওর মাথায় কোন সৃজনশীল উত্তর এলো না। মনে মনে ভাবলো সৃজনশীল প্রশ্ন না হলে উত্তর দেয়া যেতো “ভূগোল বই থেকে জানিতে পারি, স্যার”। প্রশ্নটা সৃজনশীল হয়েই যত বিপত্তি হয়েছে।
আসাদ চুপ, ক্লাশের অন্য সবাইও চুপ। স্যার আবারো জিজ্ঞেস করলেন, “কীভাবে জানিতে পারি?”
দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসার পরেও চুপ থাকা ঠিক নয় জ্ঞানে সাত্তার মুখ খুললো, বললো, “স্যার, শীতের দিনে আমাদের হাত-পা ঠান্ডায় জমে যায়, আমরা টুন্ডা হয়ে যাই। যে এলাকায় শীত যতবেশি, সে এলাকার মানুষ ততবেশি টুন্ডা। টুন্ডা এলাকায় এই চিত্র দেখতে পেয়ে একবার এক পর্যটক এই নাম দেন। তবে স্যার, অন্ধকে অন্ধ, বধিরকে বধির বলা যেমন অমানবিক, তেমনই টুন্ডাকে টুন্ডা বলাও অমানবিক। তাই ঐ পর্যটক টুন্ডা নামটিকে তুন্দ্রা নামে অভিহিত করেন। বড় ভালো পর্যটক ছিলেন।
জামান শিপলু স্যার কোনদিন রাগ দেখান না। আজ আর পারলেন না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তিনি টেবিলে ঘুষির মতো করে মারলেন। টেবিলেই মারলেন, কারণ কোন শিক্ষার্থীকে মারা ঠিক না। ঘুষির মতো মারার পরে দেখা গেল টেবিলের বেরিয়ে থাকা পেরেকে লেগে তার হাত থেকে রক্ত বেরিয়ে গেলো। স্যারের হাতের রক্ত দেখে আসাদ বলল, “স্যার, কমন রুম থেকে স্যাভলন নিয়ে আসি?” স্যারের নীরব সম্মতি পেয়ে আসাদ ছুটে গিয়ে স্যাভলন নিয়ে এলো। জামান শিপলু স্যারের মন নরম হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো স্যাভলন নামটি কোত্থেকে এলো?” আসাদ কোন উত্তর দিতে পারলো না, কারণ সৃজনশীল কোন উত্তর তার মাথায় এলো না। সে চুপ করে থাকলো। তার মতো করে পুরো ক্লাশও চুপ থাকলো, কারণ কেউই উত্তর ভেবে পেলো না। জামান শিপলু স্যার আবারো প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেন। দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসার পরেও চুপ থাকা ঠিক নয় জ্ঞানে সাত্তারই আবার মুখ খুললো, বললো, “স্যার, শ্যাম্পু যেমন আমাদের শব্দ, স্যাভলনও আমাদের শব্দ। তফাত এইযে, শ্যাম্পু অবিকৃত আছে, স্যাভলন কিছুটা বিকৃত হয়েছে।”
-শ্যাম্পু অবিকৃত আর স্যাভলন বিকৃত?
– জ্বী স্যার।
– আচ্ছা? কী রকম?
– স্যার, আমাদের এই সমতল দেশে অনেক গ্রাম রয়েছে। গ্রামের লোকজন নিজেদের মতো করে জীবনযাপন করে। নিজেদের ছোটখাটো চিকিৎসা নিজেরাই করে। আগেরদিনে গ্রাম বাংলার লোকজন তাদের শরীরের কোথাও কেটে-ছড়ে গেলে, কাটা জায়গায় থুথু লাগাতো। ঐ থুথু এন্টিসেপটিকের কাজ করতো। গ্রামের লোকেরা থুথুকে বলতো ছেপ। ইংরেজি শাসনামলে ফিরিঙ্গিরা এদেশ চষে বেড়াতো।
– ছেপ থেকে ইংরেজি শাসনামল?
– জ্বী স্যার। সৃজনশীল।
– আচ্ছা বল!
– স্যার, ফিরিঙ্গিদের দেখে গ্রামের মানুষ মজা পেত, তাদের পিছু নিত। একবার একবার ফিরিঙ্গি পর্যটক….
-আবারো পর্যটক?
– জ্বী স্যার। ভূগোল এর পর্যটক।
-আচ্ছা। বলে যা।
– স্যার, ঐ ফিরিঙ্গি পর্যটক গ্রাম বাংলা চষে বেড়ানোর সময় একদিন উষ্টা খেয়ে পড়ে যায়, পড়ে তার হাটু ছিলে যায়। পিছে পিছে আসা দুষ্ট ছেলেরা সেটা দেখে প্রথমে খুব হাসলেও, পরে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। একজন বলে, “দুর্বা চিবায়ে লাগান।” ফিরিঙ্গি সেটা বুঝতে পারেনা। পরে আরেকজন বলে, “ছেপ দেন। কাটা জায়গাডায় ছেপ দেন।” ফিরিঙ্গি সেটাও বুঝতে পারেনা। একটা ছেলে মুখ ঘুরিয়ে হাতের তালুতে থুথু নিয়ে ফিরিঙ্গিকে দেখিয়ে বলে, “ছেপ লন।” বলে ইঙ্গিতে
হাতের তালু দেখায়। ফিরিঙ্গি বুঝতে পারে ছেলেটা তাকে এন্টিসেপটিক সাধছে। ফিরিঙ্গির মনে পড়ে বাঙ্গালি খুব অতিথি পরায়ণ জাতি। সে আপ্লুত হয়, আপ্লুত হয়ে নিজের ছেপ না নিয়ে ছেলেটির হাতের তালু থেকেই ছেপ নিয়ে ছিলে যাওয়া হাটুতে লাগায় আর কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার বলতে থাকে, “ছেপ লন, ছেপ লন।” ছেপ লাগিয়ে ফিরিঙ্গির জ্বালাপোড়া ভালো হয়ে যায় কারণ ছেপটা ভালো ছিল। ছেপটা ভালো ছিল, কারণ ছেলেটাও ভালো ছিল। ছেলেটা ভালো ছিল কারণ সে কোন নেশা করতো না আর নিয়মিত দাঁত মাজতো। তারচেয়েও বড় কথা ওর মন পরিস্কার ছিল। তো স্যার, ছিলে যাওয়া হাটু ভালো হয়ে যাওয়ায় সেই ফিরিঙ্গি নিজেদের লোকদের কাছে গিয়ে এই জাদুকরী জিনিসের নাম বলে; বলে, “দেন দে গেইভ মি সাম ম্যাজিকল পোশন খল্ড ছেপলন! দ্যাট ছেপলন সেইভড মি ফ্রম জ্বালাপোড়া।”
– জ্বালাপোড়া?
– স্যার, জ্বালাপোড়া ইংরেজি জানিনা।
– আচ্ছা, ঠিকাছে। বলে যা।
– আসলে ঐ পর্যটক ছিল এক ভেষজ গবেষক, চিকিৎসক। সে একসময় একটা এন্টিসেপটিক বানায়, বানিয়ে এর নাম দেয় ছেপলন, কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। কালে সে নামটা বিকৃত হয়ে স্যাভলন হয়ে যায়।
– বাহ, ভালো বলেছিস। হালে স্যাভলন আসলেই বিকৃত হয়েছে। যাক, তোর সৃজনশীল উত্তর ভালো হয়েছে। এখন বল, ডেটল নাম কীভাবে এসেছে।
– স্যার, ক্লাশ শেষ, ঘন্টা পড়ে গেছে।