স্যার সমাচার

স্যার সমাচার; জ্যাম সাহিত্য; হেফজুর রহমান সূফী

‘স্যার’ নিয়ে ক্যাচাল কি এখনো চলছে? চলছে মনে হয়। আজকেও তো তিনজনের পোস্ট দেখলাম। যদিও এখন আর বিশ্লেষণাত্মক লেখা আসছে না, আসছে মন্তব্য টাইপের লেখা, তবুও আসছে যেহেতু, সেহেতু আমিও কিছু একটা বলি; হালের চালে সামিল হই! এদিকে আবার জ্যামটাও খারাপ লাগেনি, সিগনালে সিগনালে ‘স্যার’ ডাকায়া ছাড়তেছে! এই স্যারকে কাজে লাগাই।

তা, সরাসরি প্রসঙ্গে চলে আসি। আমার আবার বাজে অভ্যাস আছে, গল্পের অবতারণা করে প্রসঙ্গে যাওয়া। আজ তা করব না। সংযমের মাস এসেছে, গল্প করাতেও সংযম অবলম্বন করতে হবে।

তা, স্থান-স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় দু’ একটা ব্যতিক্রম ছাড়া, আমার ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে ভালো লাগে। সিনিয়রদের আমি অবলীলায় স্যার ডাকি, জুনিয়ররা আমাকে অবলীলায় স্যার ডাকে। আমাদের অফিসটা পুরো স্যারময় একটা অফিস।

নিজ অফিস ও বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগের সিনিয়রদের আমি অবলীলায় স্যার ডাকি। অন্য বিভাগের জুনিয়ররা আমাকে স্যার ডাকে। এখানে অবলীলায় বলতে পারলাম না, কারণ ব্যক্তি ও বিভাগ ভেদে ব্যতিক্রম পেয়েছি। মিথ্যে বলব না, অনুমতি দেয়ার আগেই তিন- চার ব্যাচ জুনিয়র কেউ যখন ‘ভাই’ সম্বোধন করে, তখন বিষয়টা আঁতে লাগে। আমি উত্তম- এই আত্মশ্লাঘা মনে রেখে হাসিমুখে কথা বলে যাই।

খন, স্থান-স্থান-কাল-পাত্র ভেদে স্যার ডাকটা কখন ভালো লাগে না বলি। যখন গ্রামের দিকে যাই, গ্রামের মানুষ যখন স্যার ডাকে, বুঝিয়ে দেয়, আমি আগন্তুক মাত্র, তখন সেটা ভালো লাগে না, একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করে নিজের ভেতরে । নড়াইলে যখন ছিলাম, একবার এক মনোহরি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাকে স্যার ডাকছেন কেন?” উনি মুখে হাসি নিয়েই বললেন, “আপনি তো স্যারই।” তিনি আর কিছু বললেন না।

আমি ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম এই যে, যেহেতু আমার বেশ এবং ভাষা এখানকার মতো না এবং যেহেতু কাজের সূত্র ছাড়া এখানে কেউ তেমন আসেই না, সেহেতু আমিও কোনো না কোনো অফিসে কাজের সূত্রেই এসেছি, এবং এই সূত্রমতে আমি স্যার।

বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। আমি বলেকয়েও স্যার ছাড়া আর কোনো সম্বোধন পাইনি।

টাঙ্গাইলে অফিস শেষে মাঝেমাঝেই ঘন্টা ভাড়ায় রিকশা নিয়ে গ্রামের ভেতরে চলে যেতাম। একদিন সন্ধ্যায় এক চায়ের দোকানের সামনে রিকশা থামালাম। চায়ের দোকানে গ্রামের মুরুব্বিরা বসা ছিলেন, গল্প করছিলেন। আমি সালাম দিলাম, বললাম, ভালো করে কাপ ধুয়ে চা খাওয়াতে। একজন মুরুব্বি দোকানদারকে বললেন, “টি-ব্যাগ আছ? থাকলে টি-ব্যাগ দিয়া চা দেও।” দোকানদার জানাল টি-ব্যাগ নাই। মুরুব্বি বললেন, “টি-ব্যাগ রাখবা; গণ্যমান্য লোকজন আসে, ঠিকমতো যত্ন করবা।”

এই মানুষগুলোর কাছে যেতে না পারার ব্যর্থতা এবং দূরত্বের এই স্যার ডাকটা আমার কাছে সবসময় অস্বস্তিকর লাগে।

অস্বস্তির কথা থেকে এখন বলি খারাপ লাগার কথা।

রিকশায় ওঠার পর যখন কোনো রিকশাওয়ালা ধীরে ধীরে রিকশা চালায় আর স্যার ডেকে দু একটা কথা বলতে চায়, আমি বুঝে যাই আজ আমারে মক্কেল পাইছে। বুঝে যাই কোনো দু:খের কাহিনি বলে আজ আমার কাছ থেকে বাড়তি পয়সা খসাবে।

যখন কোনো বিপনি বিতানে যাই, দোকানদার চা-কফি অফার করে, ব্যস্ততা দেখায়, আমি বুঝে যাই আমারে আজকে ছুলানোর প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। ভেতরে ভেতরে আমি ঘামতে থাকি। দোকানীর এই স্যার ডেকে বিগলিত হয়ে যাওয়াটা আমার ভেতরে একটা অজানা শংকা তৈরি করে। সবচে’ মারাত্মক লাগে যখন বলে, “স্যার, আবার আসবেন।” আমি বুঝি, আমারে ভালোই ছিলাইছে।

পরিশেষে, একটা টুলাইনার প্যারোডি-
স্যার শব্দটি ছোট্ট অতি কিন্ত জেনো ভাই

ইহার চেয়ে ধান্ধার শব্দ ত্রিভুবনে নাই।