দোলাচল

সাত্তার বাস স্টপে পৌছায় ইফতারের আগে আগে; দেখে, কাউন্টার বন্ধ। বাস কাউন্টারের কাছে যেতেই একজন বলল, “ভাই গাড়ি ছড়বো ইফতারের দশ পনরো মিনিট পড়ে।” আরেকজন এগিয়ে এসে পানির বোতল আর ছোট্ট প্লাস্টিকে মোড়া দুটি খেজুর এগিয়ে দিল। “যাত্রীদের জন্য আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে রমজানের শুভেচ্ছা”। সাত্তারের মনটা ভরে গেলো। দাপ্তরিক পীড়ায় ভারি হয়ে থাকা মনটা ভালো হয়ে যায়। না, দেশে এখনো মানুষ আছে; মানবতা আছে!
“ঐ, একটা বাসের দরজা খুইল্লা দে! যাত্রী আরামে বইসা ইফতার করবো!” আদেশকারী সম্ভবত এই কাউন্টারের সুপারভাইজার, সাত্তার ভাবে। তার কথার দাম আছে। কে একজন দাঁড়িয়ে থাকা বাসগুলোর একটার দরজা খুলে দিল। এমন কদরে সাত্তার লজ্জায় পড়ে গেল। কর্পোরেট চাকরি করে সে, এক্সিকিউটিভ অফিসার, অফিসের পিওন, দারোয়ান নিয়মিত সেলুট দেয়; তবুও বাইরের মানুষের এই আপ্যায়নে সে আপ্লুত হয়; লজ্জা অনুভব করে, কৃতজ্ঞতা অনুভব করে-

বাস স্টপের লাগোয়া টং দোকানে ইফতার বিক্রির ধূম চলছে। ফ্রি পানি আর খেজুর হাতে নিয়ে আর কিছু না কিনলে কেমন দেখায়, অন্যরা কি ভাববে-এসব চিন্তা করে সাত্তার টং দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। আলুর চপ, ডিম চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলা বুট, মুডি -এসব আছে দোকানে। ভাজাপোড়া খেলে সাত্তারের সমস্যা হয়। তবুও সে ভাবে, পাশেই দাঁড়ানো পানি দেয়া লোকটি, পাশেই দাঁড়ানো কাউন্টারের সুপারভাইজার লোকটি যদি ভাবে যে সে রোজাদার নয়, তাহলে তো লজ্জার একশেষ হবে! ওরা এত সম্মান করলো! ভেবে ভেবে সাত্তার টং দোকানি কে বলে, “ডিম চপ একটা, পেঁয়াজু দুইটা, আর আলু চপ দুইটা দেন।” দোকানি বেশ কদর করে জিনিসগুলো ঠোঙায় ভরে দেয়। ঠোঙা হাতে নিয়ে সাত্তারের ভালো লাগে। যাক, এখন আর কাউন্টারম্যান বা পানি দেয়া লোকটা ভাববে না যে সে রোজা না।
সাত্তার ধীর পায়ে দরজা খুলে দেয়া বাসের দিকে এগোয়, ঢোকে, খালি বাসের মাঝামাঝি একটা সিটে বসে, আযানের অপেক্ষা করে।
সে রোজা আছে।

কথা মতই বাস ছাড়ে, ইফতারের মিনিট দশেক পর। টিকেট কাটতে হয়নি, ইফতার শেষে বাস থেকে নেমে কাউন্টারে যেতেই কাউন্টারম্যান বলল, “ড্রাইভাররে ভাড়াটা দিয়া দিয়েন। সারাদিন বাস চালাইছে, কিছু পায় নাই।” সাত্তার সানন্দে বলল, “কোন সমস্যা নাই ভাই।” তার মনে পানি, খেজুর, আর খুলে দেয়া দরজার কৃতজ্ঞতা –

বাস চলছে, বাসে একমাত্র যাত্রী সাত্তার। ইফতারর পর আর কেউ যাত্রী হতে আসেনি। আর কেউ তার মত দাপ্তরিক দায়ে ফেঁসে যায়নি। সাত্তার দেখল, বাসে তার সহযাত্রী সেই কাউন্টারম্যান, ড্রাইভার আর হেল্পার।

বাস চলছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা; ইফতারের পর পর যেমন থাকে। বাসের তিন পরিচালনাকারী ব্যাপক হাহাহিহিতে মত্ত হয়ে গেছে। সাত্তারের মনে হঠাৎ কু চিন্তা জেগে ওঠে। আচ্ছা, ফাঁকা বাসে এরা তিন জন আমাকে চেপে ধরবেনা তো! পেটে ছুরি মেরে সব লুটে নেবে না তো! এমনতো হতেই পারে! সব কেড়ে, ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে, রাস্তার পাশে ফেলে রাখলো! হতেই পারে! পরক্ষনে ভাবে, নাহ, রোজা রমজানের দিন, এমনটা করবে না! আবার ভাবে, ফাঁকা বাসে আক্রমণের শিকার হয় মেয়েরা; ছেলেরা না। একা পাওয়া মেয়েদের উপর চড়ে ওরা মজা পায়; পুরুষার্থ কায়েম করে। ছেলেদের ওপর চড়াও হয়ে সে মজা পাবে না। সাত্তার আশ্বস্ত বোধ করে; আবার তার মন খারাপও হয় অসহায় মেয়েদের কথা ভেবে। মেয়েদের এমন লাচার রূপটা ঠিক না, এটা অন্যায়- সাত্তার ভাবে।

বাস চলছে। কাউন্টারের পর কাউন্টার পেরিয়ে যাচ্ছে; যাত্রী শুন্য। রাস্তা ফাঁকা। সাত্তার দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে, এই বুঝি হেল্পার আর কাউন্টারম্যান এগিয়ে এলো ওর পেটে ছুরি মেরে সব কেড়ে নিয়ে বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে!

বাড়ির পথে রাস্তা কমতে থাকে, বাসের তিন পরিচালনাকারীর হাসি বাড়তে থাকে, সাত্তারের উদ্বেগ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে

২৩/০৫/২০১৮
ঢাকা।