হিসাবের কাল

কাজের মৌসুমের প্রায় শেষ ভাগের দিকে কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য সবাই মহাজনের কাছে এসেছে। মহাজন উপস্থিত কামলাদের একজন একজন করে ডাকছেন আর তথ্য নিচ্ছেন। তথ্য নিচ্ছেন না বলে, হিসেব নিচ্ছেন বললে ভালো হতো; তবে তা সঙ্গত কারণেই বলা যাচ্ছে না। মহাজন ডাকলেন, কমবখ আলী?
-ছার।
-তুমারে কত টাকা দিছিলাম?
মহাজন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন সবসময়। তবে, কামলাদের সাথে আলোচনায় তিনি নিজেকে তাদের একজন হিসেবে উপস্থিত করার জন্য মাঝেমধ্যেই আঞ্চলিক ভাষায় কিছু শব্দ বলেন। তবে সব শব্দ আঞ্চলিক ভাষায় বললেও, টাকা শব্দটি কখনো বিকৃত উচ্চারণে বলেন না। তিনি জানেন, টাকা হলো লক্ষী। ইংরেজিতে বলে, গড। মহাজনের প্রশ্নে কমবখ আলী উত্তর দেয়,
– ছার। ছার, পাচপান্ন টেহা তেষট্টি পইসা।
-তুমার কাজের অরগগতি কি বলো।
-ছার।
ছার বলে কমবখ আলী থামে। উত্তর দেবার আগে ছার বলে থামতে হয়। এটাই নিয়ম।
-ছার আমার যে এলাহা দেওয়া অইছিল, সেইকানে মুট দৈরগ ৭ আর পরস্তে ৮ মাইল জুইড়া তাল গাছ লাগানির লাইজ্ঞা গর্ত করছি। এই কামে করচ হইছে তিপ্পান্ন টেহা সাতাত্তুর পইসা। অহন গাছের চারা আইসা পড়লেওই আমরা গাছ লাগায়া কাম শ্যাষ করবাম।
-গর্ত করতেই এত টাকা! পাতাল পর্যন্ত খুড়ছো নাকি!
-ছার। ছার, লেবার পাওয়া কুব মুস্কিল। অভাবি লুক আছে, কামের লুক নাই। অনেক তোয়াজ কইরা কাম করানি লাগে। তারপরে…
-থাক, বুঝেছি। গাছের চারা আসে নাই কেন? চারা কই? চারার কী ওইছে?
-ছার। ছার, গাছের চারা আননের দায়িত্ব আমার আছিন না। তাহলে আইন্না লাগায়া দিতাম।
-ও, চারা তো তুমার কাজ না! চারা ত আনার কথা গাছপালা টিমের বেইজ্জা আলীর। যাক, বেইইজা আলীরে ডাকতেছি। তার আগে তুমি বলো, বাকি টাকা কই।
ছার। ছার, কুদাল শাবল, ছেনি- এইতা ধার করাইতে অইছে, কিছু নয়া বানাইতো অইছে, এই হানো কিছু করচ গেছে। মুটমাট দরুইন তিন টেহা বেয়াল্লিশ পইসা।
আর ছার, (গলা নামিয়ে) আফনের তিনজন গেস্ট আইছিল, তের দিন চোইদ্দ রাইত থাকছে। তারারে এলাহা গুরায়া দেহাইছি, আদর সমাদর করছি, যাওয়ার সম’ উপহার দিছি। এইহানো গেছে সাত টেহা বিরাশি পইসা। ছার। আমার বিল ঘাটতি আছে। আমারে এট্টু দরায়া দেইঞ্জে।
-আইচ্ছা আইচ্ছা। দিবো নে। এইসব আলাপ বাইরে করবানা। যাও।

মহাজন বেইজ্জা আলীকে ডাকলেন। হিসেব, না না, তথ্য চাইলেন। বেইজ্জা আলী তথ্য দিতে শুরু করলো
-ছার। ছার, আমার দাইত্ত আছিন তাল গাছ আনার। যে এলাহাত তাল গাছ লাগানি হইবো, সেই এলাহা গুইরা দেকছি আমরা। লগে রাকছিলাম একজন তাল গাছ বিশেষজ্ঞ। তাইন এলাহার মাডি পরীক্কা কইরা কইছুইন এইহানো জিবরালটার জাতের গাছ ভালো হইবো। তাইনেরে তার গবেষণা আর পরিশ্রমের লাইজ্ঞা সম্মানি দেওয়া হইছে বার টেহা আটচল্লিশ পইসা। বাকি থাকছে সতরো টেহা একুশ পইসা। আমরা খুঁজ নিছি জিবরালটার জাতের গাছ পাওন যায় কুইকুই এলাহাত। আমরা সেই এলাহাত গেছি। দুর্গম রাস্তা, অনেক কষ্ট অইছে, কিন্তুক কাজে অবহেলা করছিনা। গিয়া দেহি এহন আর গাছের চারার মওসুম না। সামনের বৈশাখ মাসো পাওয়া যাইবো। আমরা কতা বার্তা কইছি। তারারে কিছু এডভান্স কইরা আইছি। আম্রার সব মিলায়া করচ অইছে তের টেহা একান্ন পইসা। আমরার আরো কিচু বরাদ্দ লাগবো।
-কাজ শেষ না কইরা সব খাইয়া বসে আছো!
-ছার। ছার, একটা পইসাও এদিক সেদিক করি নাই। বিদেশি বিশেষজ্ঞরে কম দিতো চাইছিলাম, বাদে চিন্তা করছি, আপনের লুক। খাতির না করলে আমরার ক্ষতি…
-থাক। থাক। দেখি কি করা যায়।

বেইজ্জা আলী বের হবার পর মহাজন তার ব্যক্তিগত সহকারীকে ডাকলেন, ডেকে বললেন, ওয়ারিশ আলীরে ডাক। ও সার আনার কী করলো শুনি। তারপর ডাকবে আলোকসজ্জার আধার আলীকে, এরপর অপারেটর পিদিম সরকারকে

সময় বসে থাকে না। গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় চলে যায়; কাজ তোলা থাকে আগামীর জন্য।

বাকি যাদের পরে ডাকা হয়েছিল, তাদের কথা এই লেখক এবং তার সাথে এই লেখার পাঠক -কেউই জানতে পারে না।

২৭/০৪/২০১৯
ঢাকা।